আবু মুসা বিশ্বাস.
পশ্চিমবঙ্গের বর্ষীয়ান বাঙালি অভিনয়শিল্পী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের নাম জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। উত্তম-সুচিত্রা,উত্তম-সুপ্রিয়া, উত্তম-সাবিত্রী জুটি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছিলো সিনেমা জগতের কিংবদন্তি। তবে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা হয়তো এসব জুটির বিষয়ে ওতোটা জানেন না। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বাংলাদেশে জন্ম হলেও বড় হয়েছেন তিনি কলকাতায়। তাঁর পিতা শশধর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকার (রেলওয়ের) স্টেশন মাস্টার। তিনি কুমিল্লা রেলস্টেশনেও চাকরি করেছেন। কমলাপুরে তাদের বাসা ছিলো। জানা যায় তখন ঢাকার রেল স্টেশনটি ছিলো ফুলবাড়িয়া নামক স্থানে।
তাঁদের গ্রামের বাড়ি ছিলো কুমিল্লার জেলার হাজিগঞ্জে। ১০ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর কোন ভাই ছিলোনা। তাঁর বাবার ওই চাকরিই ছিলো তাদের জীবন জীবিকার একমাত্র সম্বল। সংসারে তাঁদের টানাপোড়েন লেগেই থাকতো।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৪৯/৫০ সালে দুই দেশের (হিন্দুস্তান-পাকিস্তান) হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা যখন চরমে, তখন কোন দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ছিলোনা। পূর্বপাকিস্তান থেকে হিন্দু এবং ভারতের পশ্চিম বাংলা থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক নিজ দেশ ছাড়তে শুরু করেন।
সাবিত্রীর বয়স যখন ৭/৮বছর তখন প্রতিবেশিদের সাথে কলকাতায় চলে যান। অনিচ্ছার পরেও প্রতিবেশিদের সাথে কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন বাবা শশধর বাবু। কারণ সাবিত্রীর বিবাহিত বড়ো দু’বোন অনেকদিন আগে থেকেই কলকাতার টালিগঞ্জ থাকতেন।
ঢাকার সদরঘাট থেকে স্টিমার যোগে কলকাতার উদ্দেশে প্রতিবেশিদের সাথে রওয়ানা দিলেন সাবিত্রী। তখন সাধারণ নাগিরিকদের ভারতে যাওয়া একমাত্র নৌপথ ছিলো ঢাকা-গোয়ালন্দঘাট স্টিমার সার্ভিস। গোয়ালন্দঘাট থেকে ট্রেনে কলকাতা।
শতশত হিন্দু নারীপুরুষ স্টিমারে উঠেছেন। তীল ধারণের জায়গা নেই। ভিঁড়ের মধ্যে তাদের জায়গা জুটলো স্টিমারের দরজার কাছে। গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটের জেটিতে ভেড়ার সাথে সাথে লালজামা পরা অসংখ্য কুলি হামলে পড়লো দরজার কাছে। স্টিমার থেকে নামার সময় জেটি ও স্টিমারের ফাঁকদিয়ে পড়পড় অবস্থায় সাবিত্রীর চুল ধরে টেনে তুললেন একজন। (সাবিত্রীর তখন লম্বাচুল ছিলো)। গোয়ালন্দ ঘাট রেলস্টেশনে ভিঁড়ের চাপে তাঁর টিনের বাক্সটি কোথায় চলে গেছে সেটি আর পাননি তিনি। ওই বাক্সের মধ্যে কিছু টাকা, খাবার ও কাপড় ছিলো। সহযাত্রীদের সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি কান্নাকাটি করছিলেন। এসময় জনৈক পুলিশ হিন্দি ভাষায় তার সম্পর্কে জানতে চাইলে ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলার চেষ্টা করলে পুলিশ সহযাত্রী প্রতিবেশিদের খুঁজে বের করে দেন।
তখন দু’ধরণের ট্রেন চলতো। একটি মেইল ও অপরটি মিক্সট্রেন। তাঁরা মেইল ট্রেনে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঢাকা-কলকাতা মেইল ট্রেন নামে একটি ট্রেনও চলতো তখন। এভাবেই সাবিত্রীর গোয়ালন্দ ভ্রমণ শেষ করেন। ২২ ফেব্রæয়ারি ১৯২৭ সালে জন্ম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বয়স প্রায় ৮৫ বছর। এখনও তিনি কলকাতার নাটকপাড়ার নানা সিরিয়ালে অভিনয় করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
কৃতজ্ঞতাঃ- দূরদর্শন বাংলা,কলকাতা। লেখকঃ সাবেক কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক।
Leave a Reply