রাজবাড়ীতে ডেলেভারীম্যানের চাকুরি করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে এক শিক্ষার্থী। তবে আর্থিক সংকটের কারণে কলেজে ভর্তি এখনো অনিশ্চিত। সে রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল।
তাঁর নাম সোহানুর রহমান। দুই ভাই। বাবার নাম সাত্তার শেখ। তিনি বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন। প্রায় দেড় বছর ধরে কাজকর্ম করতে পারেন না। মা সালমা আক্তার। পাটকলে কাজ করেন। ছোট ভাই শামসুল হক সোহাগ (১৩) মাদ্রাসায় পড়ে। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। পাঁচ বছর ধরে রাজবাড়ী শহরের নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন।
সোহানুর রহমান জানায়, মাজবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর ভাল স্কুলে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয় রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবা দূরপাল্লার বাস চালাতেন। মা সংসার দেখভাল করতেন। বাবা গাড়ি চালানোর কাজে প্রায়ই বাইরে থাকতেন। তবে বাড়িতে টাকা-পয়সা পাঠাতেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখার শেষের দিকে বাবা বদলে যেতে থাকে। আরেকটি বিয়ে করেন। ফোন ধরতেন না। ঠিকমতো টাকা দিতেন না। খুব আর্থিক অনটন শুরু হয়। বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসে। বাবার টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু বাড়ি ভাড়া ও সাংসারিক ব্যয় মেটানো দুরহ হয়ে পড়ে। ভালো ভাবে বার্ষিক উত্তীর্ণ হই।
মা পাটকলে চাকুরি নেয়। এক পর্যায়ে বাবা পুরোপুরি টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফোন করলে রিসিভ করতেন না। মায়ের আয়ে কোনো মতে সংসার চলতো। আর্থিক অনটনের কারনে ছোট ভাইকে গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সপ্তম শ্রেণি স্যারদের বেতন দিতে পারতাম না। বিষয়টি বিদ্যালয়ের বাংলার সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম স্যারকে খুলে বলি। এরপর স্যার নিজে বেতন নিতেন না। অন্য স্যারদের বলে বিনাবেতনে প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি পরীক্ষার ফি দিতে না পারলেও তিনি ম্যানেজ করে দিতেন। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাই। মায়ের টাকায় সংসার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে যায়। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় টিউশনি শুরু করি। বাচ্চাটি ছোট। ঠিকমতো পড়তে চাইতো না। প্রায় তিনমাস পর টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছু জায়গার টিউশনির চেষ্টা করি। সবশেষে ফুডপান্ডায় যুক্ত হই। সেখানে প্রতিদিন গড়ে একশ টাকার মতো টাকা আয় হতো। মাসে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা আয় হতো। এরপর আমার বাবা জেলে যায়। বিয়েঘটিত বিষয় নিয়ে বরিশালে ছিল। মা জানতে পারে। আমার উপবৃত্তির টাকা ও ধারদেনা করে বাবাকে জেলখানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এরপর বাবা আবারও গাড়ি চালাতে যান। রংপুর এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হয়। দুর্ঘটনার পর বাবা আমাদের বাড়িতে চলে আসে। তিনি আর কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। মায়ের আয়ে সংসার চলে। আমি পড়ালেখার খরচ চালাই। মায়ের হাতেও কিছু টাকা দেওয়ার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও ফুডপান্ডায় কাজ করতাম। কিন্তু ওরা নানা উছিলাই টাকা কেটে নেয়। এখন টিউশনি শুরু করেছি। বই কেনা হয়নি। ভর্তির টাকাও জোগার করা হয়নি।
রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান সহকারী শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, সোহানুর রহমান একজন সংগ্রামী ছেলে। আর্থিক অনটন তাকে দমাতে পারেনি। আমরা তাকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। তবে ও সত্যিকার অর্থেই খুব মেধাবী। যে কোনো কিছু রপ্ত করতে তেমন একটা সময় নেয়না। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলে সে ভালো অবস্থানে পৌছাতে পারবে। তবে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াটাই সোহানের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
Leave a Reply