নিজস্ব প্রতিবেদক..
নাম আবদুর রহিম ধাবক। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে। আবদুর রহিম বার্ধ্যক্যজনিত কারণে মারা গেছেন ২০০৫ সালে। অথচ তাঁর নামে ২০১৫ সালে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানতেন না। দেওয়া হয়েছে লাল নোটিশ। মৃত ব্যক্তির নামে ঋণের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে চলতি বছর দুই কিস্তিতে টাকাও জমা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা স্থানীয় কিছু টাউট শ্রেণির ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজসে ভুয়া ঋণ বিতরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা সূত্রে জানা যায়, আবদুর রহিম ধাবকের নামে ২০১৫ সালের ২ আগষ্ট ৬০ হাজার টাকা কৃষি ঋণ নেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে তা পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। তা সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়ায় লাখ টাকার ওপরে। গতবছরের শেষ দিকে তাঁর নামে লাল নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরে তাঁর নামে দুটি কিস্তি জমা দেওয়া হয়। তিন হাজার টাকার প্রথম কিস্তি দেওয়া হয় চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি। পরের কিস্তিতে ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয় ১১ এপ্রিল। এখন তাঁর কাছে বকেয়া রয়েছে ১০ হাজার ১৪০ টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদনকারীকে সশরীরে ব্যাংকে উপস্থিত হতে হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, পাসপোর্ট আকারের ছবি, বাড়ির জমির খাজনা প্রদানের রশিদ, জমিজমার পর্চা বা দলিল। এরপর ব্যাংক কর্মকর্তা বা মাঠকর্মীরা তা সরেজমিনে যাচাই বাছাই করেন। তথ্যের সত্যতা পাওয়ার পর ব্যাংক ব্যাবস্থাপকের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেন। এরপর ঋণ পান ওই ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় শতাধিক ব্যক্তির নামে ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঋন দেওয়া হয়েছে।
খোশবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমরা বিশেষ প্রয়োজনে কৃষি ব্যাংক থেকে লোন নিতে যাই। ব্যাংকে গিয়ে আবেদন করেন আমার বাবা। ব্যাংক সবকিছু বিশ্লেষণ করে বলে বাবার নামে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া আছে। তা সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি বাস্তবে কোনো ঋণ নেননি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি ব্যাংকের আইও স্থানীয় এক ব্যক্তিকে বাবার নাম ও জমির পর্চা দিয়ে ঋণ নিয়েছে। তাকে চাপ দেওয়ার পর ওই ঋণ পরিশোধ করা হয়। আমাদেরও কিছু টাকা জমা দিতে হয়। সবমিলিয়ে আমাদের কাংখিত লোন পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ মন্ডল বলেন, আমি কখনো কৃষি ব্যাংকে যাইনি। আমি রাজবাড়ী একা একা ভালো ভাবে চিনিও না। কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের নামে ব্যাংক ঋনের লাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশ পাওয়ার পর খুব চিন্তায় পড়ে যাই। পরে চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে যাই। সবকিছু খুলে বলি। এরপর দেখি আমার আরও এক ভাইয়ের নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তিন ভাইয়ের প্রতিটি ঋণের পরিমান ৬০ হাজার টাকা। এই টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাক ১৫ হাজার টাকা। আমার নামে হরিহরপুর গ্রামে আবদুল আলিম নামে এক ব্যক্তি লোন নিয়েছেন।
ইউসুফ মন্ডলের আরেক ভাই ছলিম মন্ডল বলেন, লোনের কথা জানার পর ব্যাংকে যাই। গিয়ে দেখতে পাই দলিলের পিছনে আমার মা ও যিনি ব্যাংক লোন নিয়েছেন তাঁর ছবি। আমার মা মারা গিয়েছে ২০০২ সালের আগে। ব্যাংকের অফিসাররা বলেছেন জালিয়াতি হয়েছে। এসব ঠিক করতে সময় লাগবে।
খানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাহার হোসেন বলেন, ব্যাংকের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় কিছু খারাপ লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে এই অনৈতিক কাজ করেছে। অযোগ্য ব্যক্তিদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক ব্যক্তি ঘুষ না দেওয়ায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ পায়নি। ভুয়া ঋণের বিষয়ে আমি উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে একাধিকবার কথা বলেছি।
আবদুর রহিম ধাবকের ছেলে শহীদুল ধাবক বলেন, আমার বাবা বা আমরা কেউ কৃষি ব্যাংক থেকে ঋন নেইনি। যে ব্যক্তি ঋন নিয়ে ছিল তিনি পরিশোধ করে দিচ্ছেন। যতদুর জানি ব্যাংকের লোন প্রায় পরিশোধ হয়ে গেছে। তবে ঋন নেওয়া ব্যক্তির নাম প্রকাশ করতে চাননি।
কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক মোতাহার হোসেন বলেন, এই শাখায় খেলাপী ঋণ রয়েছে ১৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। আমি এই শাখায় যোগদান করেছি চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি। আর এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ২০১৫-১৬ সালের দিকে। এবিষয়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় একটি তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটি তদন্ত করার পর প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু কত টাকা ভুয়া ঋণ তা জানিনা। তবে রেজাউল হক ও মোর্তজা আলী নামে দুইজন কর্মকর্তাকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
Leave a Reply